রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০০৯

গল্প#১

বাসর রাতে বেড়াল মারা সহজ কাজ নয়!!

গতকাল রাতেই – ঠিক সাড়ে দশটায় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বশীর মারা গেল। রাত সাড়ে বারোটার দিকে আমরা সবাই মিলে তাকে ঠেলেঠুলে কবরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসলাম। কবরে ঢোকার ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ ছিল না – সে চাইছিলো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আরও কিছুক্ষন আড্ডা পেটাতে। কিন্তু সারাদিন খাটাখাটুনির পর বন্ধুত্বের কাতর আহ্বান এর চাইতে চৌকির আহ্বান অনেক বেশী আকর্ষণীয় লাগছিল। সেকারনেই তাকে কবরে ঠেলে দেয়া।
বশীরের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা যতটা আত্মিক, তার চাইতে ও বেশী আর্থিক। গত কয়েক বছরে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে বাড়তে চল্লিশ হাজার অব্দি গিয়ে পৌঁছেছে।
আজ সকালে মেস ম্যানেজার আমায় ডেকে বললেন,“কিরে ভাই। দুমাস ধরে বিনা ভাড়ায় বেশ তো চৌকিদারি করছেন – আজকের মধ্যে ভাড়া না দিলে বিছানাপত্র সব বারান্দায় যাবে – জমিদারী করতে হবে তখন।”
শীতের রাতে জমিদারী করার চাইতে চৌকিদারি করাটাই শ্রেয়তর মনে হয় আমার কাছে। আর তাই বশীরের কাছে যাওয়া।
বশীরের বাড়ীটা দেখতে বেশ সুন্দর – বাগান ঘেরা একতলা বাড়ী। মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর রড – সিমেন্টের আড়তদারি করে বেশ পয়সা বাগিয়েছে সে। তাই বউ বাগাতেও বেগ পেতে হয়নি তাকে।
গিয়ে দেখি বাড়ীর সামনের বারান্দার বশীরের ছোট ভাই হেলাল মুখস্থ হয়ে বসে আছে। এই বাঁদরটা পুরোপুরি উড়নচন্ডী – পয়সা উড়ানোই তার একমাত্র কাজ। হেলালের মত উড়নচন্ডী ছেলে, যাকে কিনা সবসময়ই পরের মুখে হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায় – সেই ছেলেকে মুখস্থ হয়ে বসে থাকতে দেখলে উদ্বিগ্ন হবারই কথা।
‘দাদা কোথায়?’
‘হাসপাতালে’ – হেলালের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
বিয়ের আরেক অর্থ নিজের কবর খোঁড়া। আর কবর যে পাতালমুখী হবে এ বিষয়ে কার সন্দেহ থাকতে পারে। সেকারনেই পাতালের কথায় ভাবিত হইনা।
“গতকাল রাতে যে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছি সেই তখন থেকেই আছেন বুঝি?” হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করি আমি।
হেলাল ততোধিক মুখ ভার করে জবাব দেয় –“মাঝরাতের দিকে একবার বেরিয়েছিলেন । আর ঢুকতে পারেননি সেখানটায়। অ্যাম্বুলেন্স এসেছিলো কিনা!”
অ্যাম্বুলেন্সের কথায় ভয় খাই! বাসর রাতে অনেক পুরুষের শৌর্য – বীর্যের কাহিনী লোকমুখে প্রচুর শুনেছি। তেমনি কিছু একটার আশংকায় ভাবিত হই।
“ভাবী ভালো আছেন তো এখন?” হেলালের দিকে আড়াআড়ি ভাবে প্রশ্ন ছুড়ে দিই।
বিস্মিত চোখে হেলাল বলে, “ভাবীর তো কিছু হয় নি। তিনি খারাপ থাকবেন কেন? হাসপাতালে নিতে হয়েছে দাদাকেই।”
“কেন? দাদাকে কেন?”
“দাদা বাসর রাতে বিড়াল মারতে গিয়েছিলেন। মারবেন কি – উল্টো নিজেই পা ভেঙ্গে মরে পড়ে আছেন এখন।” হেলালের উত্তর আমায় তাড়া দেয় – তাড়নায় ও ফেলে দেয়। আর্থিক তাড়না – যা কিনা আত্মিক তাড়নার চাইতেও বেশী শক্তিশালী।
আর্থিক সম্পর্ক রক্ষাকল্পে আত্মিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজন অনুভব করতে থাকি। আর তাই কথা বাড়াতে যাই না, হেলালের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াই।
হাসপাতালে গিয়ে দেখি বশীর চৌকিদার হয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। “কি নতুন জামাই? আপনার পা’য়েরা কেমন আছে?" হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করি আমি।
“আর বলবেন না দ্রোহী ভাই। রেডিও – আলনা সব ভেঙে বসে আছি।” মুখ ভার করে বলে বশীর।
আমি অবাক হই, “ওগুলো হাতের হাড় না? কিন্তু আপনার না পা ভাঙলো? ”
“আরে ধুর! আমি হাড়ের কি জানি? আমি বলছিলাম বিয়েতে উপহার পাওয়া রেডিও, আলনার কথা।” বিরক্তি প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না বশীর।
আমি জিজ্ঞাসা করি, “ঘটনাটা খুলে বলুন তো!”
বশীর বলতে শুরু করে, “আপনিতো জানেনই বাসর রাতে বিড়াল মারতে হয়। তাই একটা বিড়াল বাসর ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলাম যাতে প্রয়োজন পড়লে ব্যবহার করা যায়। গিয়ে দেখি বউ আমার ভীষন শান্তিপ্রিয়। আর তাই বিড়াল মারার কথা মনে রইলো না।”
“তারপর?” ছোট্ট করে বলি আমি। অনেকটা তাল দেবার জন্যই।
বশীর বলতে থাকে: “মাঝরাতে খাট থেকে নামতে যাচ্ছিলাম পানি খাবার জন্য। অন্ধকারে পা গিয়ে পড়েছে বিড়ালের পিঠের উপর। পিঠের উপর এই অযাচিত পৃষ্ঠপোষকতা তার সহ্য হয়নি। তাই একেবারে নামিয়ে দিয়ে গেছে আমায়।” বলে মুখ নামিয়ে চেয়ে থাকে পায়ের দিকে।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন